নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৬ কিলোমিটার দক্ষিণে আত্রাই উপজেলার নাগর নদের তীরে রবী ঠাকুরের এ পতিসর কুঠিবাড়ী অবস্থিত। পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত কালিগ্রাম পরগনার জমিদারী দেখাশোনার জন্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯১ সালে সর্বপ্রথম পতিসরে আসেন। জমিদারী দেখা শোনার জন্য এলেও প্রকৃতি ও মানব প্রেমী কবি অবহেলিত পতিসর এলাকার মানুষের জন্য দাতব্য চিকিৎসালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা সহ অনেক জনহৈতিষি কাজ করেন। এখানকার কৃষকের কল্যানে নোবেল পুরস্কারের ১ লক্ষ ৮ হাজার টাকা দিয়ে তিনি এখানে একটি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। কবির সাহিত্য সৃষ্টির একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে পতিসর। পতিসরে বসেই কবি- চিত্রা, পূর্ণিমা, সন্ধ্যা, গোরা, ঘরে-বাইরে সহ অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯৩৭ সালের ২৭ জুলাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষবারের মত পতিসরে আসেন। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও দাড়িয়ে আছে পতিসর কুঠিবাড়ী। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৯০ সালে এ কুঠি বাড়ীটির দায়িত্ব গ্রহণ করে ।
ক্রয়সূত্রে ১৮৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর কালিগ্রাম পরগনা জমিদারির অন্তর্ভূক্ত করেন। পতিসর কালিগ্রাম পরগনার সদর দপ্তর। নওগাঁ, বগুড়া ও নাটোর জেলার ৬ শ টি গ্রাম নিয়ে কালিগ্রাম পরগনা গঠিত। এর আয়তন ছিল ২৩০ বর্গমাইল। রাতোয়াল আর ভান্ডারগ্রাম আরো দুটি সাব কাচারী ছিল। রাতোয়াল পতিসর থেকে ১০ কিলোমিটার আর ভান্ডারগ্রাম ২০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। কালিগ্রাম পরগনার সীমানা ছিল উত্তরে মালশন আদমদিঘী দক্ষিনে আত্রাই নদী, পূর্বে নাগর নদীর পশ্চিম তীর আর পশ্চিমে নাগর বিধৌত বাঁকা-কাশিয়াবাড়ি গ্রাম। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বাংলাদেশে ছিল ৩ টি জমিদারী। পতিসরে কবির গুরুর আসা ইচ্ছাকৃত ভাবে নয়, অনেকটাই ভাগ্যক্রমে । এজমালি সম্পত্তির সবশেষ ভাগে বিরাহিমপুর ও কালিগ্রাম পরগনার মধ্যে সত্যেন্দ্র পুত্র সুরেন্দ্রনাথকে তাঁর পছন্দের অংশ বেছে নিতে বললে সে তখন বিরাহিমপুরকে পছন্দ করে তখন স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের অংশে এসে পরে কালিগ্রাম পরগনা যার সদর পতিসর।
প্রথমে পতিসর তাঁকে ভাল লাগেনি। কিন্তু পরবর্তীতৈ পতিসরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁকে মুগ্ধ করে। মুগ্ধ করে কালীগ্রামের সহজ সরল প্রজা সাধারনের ভক্তি ও শ্রদ্ধা। এখানে এসে তিনি কৃষকদের খুব কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। এতে কৃষকের অর্থনীতি সম্পর্ককে ভালো ধারনা জন্মেছিল। পতিসরের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল অগাধ ভালবাসা, ছিল এখানকার মানুষের প্রতিও। তার বিচক্ষনতা দিয়ে প্রজাহ্নদয় জয় করেছিলেন। জমিদারি পরিচালনা পদ্ধতিও ছিল আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মত। তাই তিনি তাদের আপনজন হয়ে যান। তখন প্রজা ও জমিদারের সম্পর্কের ব্যবধান কমে আসে।
তিনি অনুন্নত পরগনার রাস্তা-ঘাট শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও দারিদ্র বিমোচনসহ নানাবিধ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হাতে নেন। কর্মসূচির মধ্যে ছিল গ্রামে গ্রামে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি শিল্প, ব্যাংক স্থাপন, রাস্তাঘাট নির্মান, কূপ, দীঘি ও পুকুর খনন, জঙ্গল পরিস্কার, গ্রাম্য শালিশী ব্যবস্থা ও মহাজনের সুদের হাত থেকে দরিদ্র প্রজাদের রক্ষা করা। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য পরগনাকে ৩টি বিভাগে ভাগ করেন। কালিগ্রাম ”হিতৈষী সভা” নামে একটি সংগঠন তৈরী করেন। কালীগ্রাম পরগনার প্রজাদেরকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে পতিসর, রাতোয়াল ও কামতা ৩টি বিভাগে ৩টি মধ্য ইংরেজী (এম.ই) স্কুল ও পতিসরে ছেলে রথীন্দ্রনাথের নামে ১টি হাইস্কুল স্থাপন করেন। স্কুলের ভবন, ছাত্রাবাস নির্মাণ ও অন্যান্য খরচ এস্টেট থেকে বহন করা হতো। পতিসরে অবস্থিত কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনষ্টিটিউশনের প্রথমে নাম ছিল পতিসর এম.ই স্কুল। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালে বিদ্যালয়টি হাইস্কুলে রুপান্তরিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এটি ছিল নওগাঁর জেলার তৃতীয় হাইস্কুল। ১৯১৩ সালের জানুয়ারী মাসে রাতোয়াল বিভাগে একটি বিদ্যালয় এবং কামতায় আরো একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠান গুলোর প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই।
একথা বলা মোটেই অত্যুক্তি হবে না যে, পূর্ব বাংলায় ’জমিদারি’ করতে এসে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতই নিজেকে আবিস্কার করেছিলেন নতুন করে। পতিসরে বসেই তিনি গোরা ও ঘরে বাহিরে (অংশ বিশেষ) উপন্যাস, ছোট গল্প ’প্রতিহিংসা’ ও ঠাকুরদা, লিখার রসদ পেয়েছিলেন। পূর্ণিমা, সন্ধ্যা, চৈতালি-মধ্যাহ্ন, পল্লীগ্রামে, সামান্য লোক, দুর্লভ জন্ম, খেয়া, কর্ম , মেঘদূত, দিদি , পরিচয়, অনন্তপথে ’র মত অনেক কবিতা রচনা করেছিলেন। রচনা করেছিলেন কিছু হৃদয় স্পর্শ করার মত গান যেমন বিধি ডাগর আাঁখি—-, জলে ডোবা চিকন শ্যামল—-, বধু মিছে রাগ করো না—-, আমি কান পেতে রই —, তুমি নব রুপে এসো প্রানে—-।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর হৃদয়ের অন্তঃস্থলে অনুভব করেন দরিদ্র প্রজাদের দুঃখ দুঃদশার কথা। জমিদারি পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি কখনও প্রজা পীড়ক হতে পারেননি। উল্টো দিকে তিনি খাজনা মওকুফ করেছিলেন তার সমগ্র জমিদারীতে। পল্লীর উন্নয়ন ও কর্ম পরিকল্পনার রুপকার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হিসাবে এবং মহাজনদের হাত থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে সমবায় পদ্ধতিতে ১৯০৫ সালে কালিগ্রাম পরগনার পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন । নোবেল পুরস্কারের ১লক্ষ ৮ হাজার টাকা এই ব্যাংকে বিনিয়োগ করা হয়। ১৯১০ সালে উত্তরবঙ্গের মহাপ্লাবনের পর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মহাশয়ের বন্যাত্রাণ ফান্ডে কিছু টাকা উদ্বৃত্ত হইয়াছিল এবং এই টাকায় আমেরিকা হইতে কয়েকটি ট্রাক্টর ক্রয় করা হয়। রবীন্দ্রনাথ একটি ট্রাক্ট্রর লইয়া পতিসর অঞ্চলে কলের লাঙ্গল দিয়া জমি চাষ প্রবর্তন করেন। ট্রাক্ট্রর পাওয়া গেলে, কিন্তু চালক পাওয়া গেল না। পুত্র রথীন্দ্রনাথ আমেরিকায় কৃষিবিদ্যা শিক্ষাকালে ট্রাক্ট্রর চালনা করিয়াছেন। পতিসরে তাই তিনি ট্রাক্ট্ররের ড্রাইভার রুপে আশে পাশে জমি চাষ করিয়াছেন। যন্ত্রদানবের কার্যকলাপ দেখিতে প্রথম দিন হাজার হাজার লোক পতিসরে উপস্থিত হইয়াছিল। ১৯৩৭ সালে তিনি পতিসর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সব সম্পদ প্রজাদের মধ্যে দান করে দেন।
কাচারী বারির ভেতরে ঢুকতেই পড়বে রবিঠাকুরের আবক্ষ মূর্তি। এর ভাস্কর কণক কুমার পাঠান।ঘরগুলো কবির ব্যবহার্য বিভিন্ন তৈজসপত্র, নানা রকম সামগ্রী, তাঁর হস্তলিপি আর বিভিন্ন ছবিতে ভরা। একটি বাথটাব, একটি নোঙর, বিশাল আয়না, আরাম কেদারা, ওয়্যারড্রব, ঘড়ি, গ্লোব, সিন্দুক, খাজনা আদায়ের টেবিল, খাট, আলমারি, দরজার পাল্লা, জানালা ইত্যাদি। পাশেইরয়েছেকবির ছেলের নামে প্রতিষ্ঠিত রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন।
যোগাযোগ
নওগাঁর আত্রাই এর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ট্রেন যোগাযোগ খুবই ভালো। তাই আত্রাই এ আসতে হলে ট্রেনে আসাই উত্তম। ঢাকা থেকে আন্তনগর ট্রেন নীলসাগর, লালমনি এক্সপ্রেসে চড়ে প্রথমে আত্রাই আসতে পারেন। এছাড়াও নওগাঁ ও নাটোরের সঙ্গে আত্রাই এর যোগযোগ ভালো। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে বাস কিংবা ট্রেনে নওগাঁ/শান্তাহার বা নাটোর এসে পরে আত্রাই আসতে পারেন। নাটোর থেকে আত্রাই বাস, ট্রেন ও নদীপথে নৌকায় আত্রাই আসা যায়। আত্রাই থেকে পতিসর কাচারিবাড়ি যেতে হবে নসিমনে চড়ে, যা পর্যটকদের ভ্রমণে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। ট্রেন স্টেশনের নিচেই রয়েছে নসিমন/ভুটভুটি স্টেশন। আত্রাই থেকে পতিসরের দূরুত্ব ১৪ কিমি.।
কোথায় থাকবেন
কাচারিবাড়ির দক্ষিণ দিকে শান বাঁধানো রবীন্দ্র সরোবরের পাড়ে রয়েছে জেলা পরিষদের দোতালা ভবন। থাকতে চাইলে আগে থেকে আত্রাই উপজেলা পরিষদের অনুমতি নিতে হবে এবং খাবার ব্যাপারটিও নিশ্চিত করে আসতে হবে। এখানকার বিশেষ খাবারের মধ্যে রয়েছে নদী ও বিলের দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন সুস্বাদু মাছ।
ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
রবীন্দ্রনাথের জন্ম দিবস ২৫ বৈশাখকে ঘিরে এখানে জাতীয় পর্যায়ের রবীন্দ্র উৎসব ও মেলা হয়। এ সময় দেশ-বিদেশের রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষের ঢল নামে, তখন এখানে আসতে পারেন। বর্ষার সময় এখানে আসলে কুঠিবাড়ির পাশাপাশি এখানকার নদী, পাশের বিশাল বিলে নৌকা নিয়ে ঘুরতে পারেন। তাছাড়াও বছরের যেকোনো সময় আসতে পারেন রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত পতিসরের টানে।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS