নওগাঁ জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের একটি প্রশাসনিক জেলা। বৃহত্তর বরেন্দ্র অঞ্চলের অংশ হিসেবে পরিচিত এই জেলাটি ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। নওগাঁ জেলার আয়তন ৩,৪৩৫.৬৫ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ২৭ লক্ষ (২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী)।
নওগাঁ জেলা রাজশাহী বিভাগের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এর উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, দক্ষিণে নাটোর ও রাজশাহী জেলা, পূর্বে জয়পুরহাট ও বগুড়া জেলা এবং পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা অবস্থিত। নওগাঁ জেলার আয়তন ৩,৪৩৫.৬৭ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, নওগাঁ জেলার জনসংখ্যা ২৬,০০,১৫৮ জন।
নওগাঁ জেলার ভূ-প্রকৃতি সমতল। বর্ষাকালে এই জেলায় বন্যা দেখা দেয়। এই জেলার উত্তর-পূর্বে পাহাড়ি টিলা আছে। নওগাঁ জেলার প্রধান নদীগুলো হল আত্রাই, পুনর্ভবা, ছোট যমুনা, নাগর এবং শিব। নওগাঁ জেলার জলবায়ু মৌসুমী। গ্রীষ্মকাল অত্যধিক গরম ও আর্দ্র, এবং শীতকালে মনোরম পরিবেশ বজায় থাকে।
নওগাঁ জেলার মাটি বেলে-বাঁধ, দোঁআশ এবং চুনাপাথর। এই জেলা একটি কৃষিপ্রধান জেলা। এখানে ধান, পাট, গম, আখ, যব, তিল, সরিষা, মুগ, মসুর, চিনা, আদা, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি সহ বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্য উৎপাদিত হয়। কৃষিপ্রধান জেলা হওয়ার পরেও নওগাঁ জেলায় প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেল সম্পদ রয়েছে।
নওগাঁ জেলার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। মৌর্য, গুপ্ত, সেন এবং পাল রাজাদের শাসনকালে এই অঞ্চল অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এছাড়াও, মধ্যযুগে নওগাঁ জেলা একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। মুসলিম শাসনামলে, এই অঞ্চলটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক শিক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। মধ্যযুগের পর, ব্রিটিশ শাসনামলে, নওগাঁ জেলা একটি কৃষিপ্রধান অঞ্চলে পরিণত হয়।
ব্রিটিশ শাসনামলের পতন হওয়ার পর ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান এবং ভারত নামে দুইটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের দুইটি অংশ ছিলো। পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের নির্মম শোষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে নেমে পড়ে। ঐতিহাসিক সেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নওগাঁ জেলার মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতার পর, নওগাঁ জেলা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষি ও শিল্প জেলা হিসেবে বিকশিত হয়েছে। নওগাঁ জেলার মানুষ কৃষি এবং শিল্প খাতে তাদের অর্থ এবং শ্রম বিনিয়োগ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, নওগাঁ জেলার জনসংখ্যা ২৬,০০,১৫৮ জন। এর জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৮০৪ জন। নওগাঁ জেলার বেশিরভাগ মানুষ মুসলিম (৮৬.৫৫%)। হিন্দু (১১.০৮%) , খ্রিস্টান (০.৭১%) এবং অন্যান্য (১.৬৬%) ধর্মাবলম্বীও এই জেলায় বাস করে।
নওগাঁ জেলার প্রধান ভাষা বাংলা। কিছু মানুষ সাঁওতালি ও উর্দু ভাষায়ও কথা বলে। নওগাঁ জেলায় সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, মাহালী, বাঁশফোঁড়, কূর্মি মাহাতো, মাল পাহাড়ি নামক ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। নওগাঁ জেলার সমাজ মূলত গ্রামীণ। এখানে বেশিরভাগ মানুষ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
নওগাঁ জেলার শিক্ষার হার ৬২%। এখানে বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নওগাঁ জেলার সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। এখানে বিভিন্ন ধরনের লোকশিল্প, লোকগান ও লোকনৃত্য রয়েছে। এছাড়াও, নওগাঁ জেলায় বিভিন্ন পেশার মানুষ বসবাস করে।
নওগাঁ জেলার অধীনে মোট ১১টি উপজেলা রয়েছে। নিম্নে এই উপজেলাসমূহের নাম উল্লেখ করে দেয়া হল —
সাপাহার উপজেলা
পত্নীতলা উপজেলা
রাণীনগর উপজেলা
বদলগাছী উপজেলা
ধামইরহাট উপজেলা
নওগাঁ সদর উপজেলা
মান্দা উপজেলা
পোরশা উপজেলা
মহাদেবপুর উপজেলা
নিয়ামতপুর উপজেলা
আত্রাই উপজেলা
উপজেলাগুলো ছাড়াও নওগাঁ জেলায় ০৩টি পৌরসভা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে —
নওগাঁ পৌরসভা
নজিপুর পৌরসভা
ধামইরহাট পৌরসভা
নওগাঁ জেলার শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমশ উন্নতি লাভ করছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষার হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। নওগাঁ জেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১৩৭৪টি। এছাড়াও, সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে ৪টি।
নওগাঁ জেলার শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নিম্নরূপ —
শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (পিটি। আই) আছে মোট ১টি।
সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে মোট ১টি।
সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ আছে মোট ২টি।
এইচএসসি (বিএম) কলেজ আছে মোট ৪৪টি।
বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ আছে মোট ১টি।
কামিল মাদ্রাসা আছে মোট ২টি।
বেসরকারি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে মোট ৭৫টি।
এসএসসি (ভোকেশনাল) স্কুল আছে মোট ৩৮টি।
বেসরকারি মহাবিদ্যালয় আছে মোট ৭৪টি।
বেসরকারি কৃষি কলেজ আছে মোট ২টি।
বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে মোট ৩৭৫টি।
ফাজিল মাদ্রাসা আছে মোট ৩৩টি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে মোট ১৩৭৪টি।
আলিম মাদ্রাসা আছে মোট ৪০টি।
পলিটেকনিক ইন্সটি। টি। উট আছে মোট ১টি।
রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে মোট ৪৮২টি।
দাখিল মাদ্রাসা আছে মোট ২০২টি।
সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় আছে মোট ৪টি।
সরকারি মহাবিদ্যালয় আছে মোট ৬টি।
জেলায় শিক্ষার গড় হার ৪৪.৫২% (পুরুষদের ৪৬.৪৭% এবং মহিলাদের ৪৩.৬০%)।
নওগাঁ জেলায় অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। নওগাঁ জেলা শুধু কৃষি সমৃদ্ধ জেলা হিসেবেই পরিচিত নয়, বরং ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের এক অপূর্ব জায়গা হিসেবেও পরিচিত। নওগাঁ জেলার কিছু বিশেষ দর্শনীয় স্থানসমূহ হচ্ছে —
সোমপুর বিহার: এটি ৮ম শতাব্দীর একটি বৌদ্ধ বিহার, বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীনতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। সোমপুর বিহারকে নওগাঁ জেলার অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পতিসর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাচারিবাড়ী, যেখানে তিনি তার কিছু বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম রচনা করেছিলেন। বিখ্যাত এই কাচারিবাড়ীটি নওগাঁ জেলায় অবস্থিত।
জগদল বিহার: ১৮শ শতাব্দীর একটি হিন্দু মন্দির, এর স্থাপত্যশৈলী অনন্য। পুরো বাংলাদেশে এমন স্থাপত্যশৈলী বিরল।
নওগাঁ জেলার সংস্কৃতি ঐতিহ্য, রীতিনীতি ও লোকাচারের এক মনোমুগ্ধকর মিশ্রণ। এখানে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে নিজস্ব সংস্কৃতি ধারণ করে বসবাস করে। নওগাঁ জেলার কিছু ঐতিহাসিক সংস্কৃতি হচ্ছে —
নকশি কাঁথা: নওগাঁ জেলার নকশি কাঁথা পুরো দেশব্যাপী বিখ্যাত। পুরাতন শাড়ি বা যেকোনো কাপড় ব্যবহার করে কাঁথা তৈরি করা হয়। এরপর, উক্ত কাঁথায় বিভিন্ন নকশা ও চিত্রকর্ম করা হয়। এভাবে করে নওগাঁ জেলার নকশি কাঁথা তৈরি করা হয়।
মাটির শিল্প: নওগাঁ জেলার মাটির শিল্পও বেশ জনপ্রিয়। এখানে বিভিন্ন ধরনের মাটির তৈরি জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। হাড়ি-পাতিল, বাচ্চাদের খেলনা, ফুলদানি ইত্যাদি সহ আরও অনেক মাটির শিল্প নওগাঁ জেলায় দেখা যায়।
কাঠের কাজ: নওগাঁ জেলার কাঠের কাজও উল্লেখযোগ্য। এখানে বিভিন্ন ধরনের কাঠের তৈরি জিনিসপত্র তৈরি করা হয়।
নওগাঁ জেলার লোকগান এর মধ্যে ভাটিয়ালি গান অনেক বেশি জনপ্রিয়। এছাড়াও, লোকনৃত্যের মাঝে গম্ভীরা নৃত্য এবং মুখোশ নৃত্য অনেক বেশি জনপ্রিয়। এগুলো ছাড়াও নওগাঁ জেলায় অনেক লোকগান এবং লোকনৃত্য প্রচলিত রয়েছে যা নওগাঁ জেলার প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করছে।
নওগাঁ জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। এখানে প্রায় ৮০% মানুষ কৃষিকাজের সাথে জড়িত। ধান, পাট, গম, আখ, যব, তিল, সরিষা, মুগ, মসুর, চিনা, আদা, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি এখানকার প্রধান ফসল। এছাড়াও, মাছ ধরা, পশুপালন, ছোটোখাটো শিল্প ও বাণিজ্য করে অনেকেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
এক নজরে নওগাঁ জেলা
১ |
নওগাঁ জেলা উন্নীত হয় |
১ মার্চ ১৯৮৪খ্রিঃ |
২ |
আয়তন |
৩,৪৩৫.৬৭ বঃকিঃ (১,৩২৬.৫২ বঃমাঃ) |
৩ |
লোক সংখ্যা |
২৩,৮৫,৯০০ জন ( পুরুষ-১২,৩০,০০০ জন এবং মহিলা-১১,৫৫,৯০০ জন) (২০০১ সনের আদম শুমারী অনুযায়ী) |
৪ |
উপজেলা সংখ্যা |
১১টি |
৫ |
পৌর সভার সংখ্যা |
০৩টি |
৬ |
ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা |
৯৯টি |
৭ |
গ্রামের সংখ্যা |
২৮৫৪টি |
৮ |
ভূ-প্রকৃতি |
দোঁয়াশ/বরেন্দ্র |
৯ |
ধর্ম |
ইসলাম,সনাতন,খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি |
১০ |
উপজাতি |
সাওতাল,উরাও,মুন্ডা,সুরিয়া পাহাড়ি, বাঁশফোড়া,কুরমি ইত্যাদি |
১১ |
বিখ্যাত ব্যক্তি |
হোসাইন, তৈয়ব উদ্দিন আহমেদ, চৌধুরী, মোজাফফর হোসাইন কাকি,বাবু,কুমুদ নাথ দাস, মোঃ আব্দুল জলিল, মোঃআখতার হামিদ সিদ্দিকী |
১২ |
কৃষিজাত খাদ্য |
বোরো, রোপা আমন, ইক্ষু, ভুট্টা, আলূ,শরিষা, গম আম, কলা ইত্যাদি |
১৩ |
ক্ষুদ্র শিল্প কারখানা |
অটোমেটিক রাইস মিল, হাসকিং মিল,আইস মিল, স-মিল ইত্যাদি |
১৪ |
নদী |
ছোট যমুনা , আত্রাই, পুণর্ভবা |
১৫ |
দর্শণীয় স্থান সমূহ |
১। কুসুম্বা মসজিদ (মান্দা) ২। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার (বদলগাছী) ৩। পতিসর কাছারী বাড়ী (আত্রাই) ৪। ভীমের পান্টি (ধামইরহাট) ৫। দিব্যক জয়স্তম্ভ (পত্নীতলা) ৬। মাহিসন্তোষ (ধামইরহাট) ৭। বলিহার রাজবাড়ী (নওগাঁ সদর) ৮। আলতাদিঘী (ধামইরহাট) ৯। জগদল বাড়ী (ধামইরাত) ১০। হলুদ বিহার (বদলগাছী) ১১। দুবলহাটী জমিদারবারী (নওগাঁ সদর) |
১৬ |
ডাক বাংলো |
১৩টি |
১৭ |
বি ও পি |
২৬টি |
১৮ |
সিনেমা হল |
২১টি |
১৯ |
টেলিফোন একচেঞ্জ |
১২টি |
২০ |
মসজিদ |
৪,৫৭০টি |
২১ |
মন্দির |
৫৪২টি |
২২ |
গির্জা |
৫৩টি |
২৩ |
রাস্তা |
ক) পাকা-৪০১.২৫ কিঃমি, এইচবিবি-১৫কিঃমিঃ, কাঁচা- ৯৯.৭৫কিঃমি খ) এলজিইডি এর ৫০৪৮ কিঃমি (পাকাঁ ১১৯১ কিঃমিঃ,এইচবিব-১৭৫ কিঃমি, কাঁচা ৩৬৮২ কিঃমি) গ) জেলা পরিষদের ১৬৯৩.৭৫ কিঃমি (পাকা এইচবিবি ও কাঁচা সহ) |
২৪ |
রেল পথ |
২৭ কিঃমি |
২৫ |
রেলওয়ে স্টেশন |
রাণীনগর, শাহগোলা ও আহসাগঞ্জ |
নওগাঁ জেলা ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ঐশ্বর্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। নওগাঁ জেলার মানুষেরা কৃষি কাজ এবং শিল্প ও বাণিজ্য করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS