নওগাঁ জেলার পত্নীতলা থানার দিবর দীঘি বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক দীঘি হিসাবে পরিচিত। এই দীঘি যা স্থানীয় জনগনের কাছে "কর্মকারের জলাশয়" নামে পরিচিত, প্রায় ৬০ বিঘা (২০ একর) জমির উপর অবস্থিত। দিবর দীঘির মধ্যখানে “দিব্যক জয়” স্তম্ভ অবস্থিত, যা অখণ্ড গ্রানাইট পাথর দ্বারা নির্মিত হয়েছে। এই স্তম্ভের উচ্চতা হলো প্রায় ৩১ ফুট ৮ ইঞ্চি। পানির নীচের অংশ ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি এবং পানির উপরের অংশ ২৫ ফুট ৫ ইঞ্চি বিশিষ্ট।
দিবর দীঘির মাঝখানে সুন্দরভাবে অলঙ্কৃত অখন্ড গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভের সঙ্গে আজও অতীতের বাঙালী শৌর্যবীর্যের সাক্ষ্য রয়েছে। দীঘির চারপাশে চমৎকার পরিবেশ দেখে আপনাদের চমৎকার লাগবেই।
এই দীঘিটি পাল সাম্রাজ্যের সময় উদ্ঘাটন করা হয়েছিল। প্রাচীন রাজারা পাল কুলের দ্বিতীয় মহীপালকে পরাজিত করে পাল সিংহাসনে আরোহন করেন। এই দীঘিটি এই ইতিহাস আজও ধরে রাখে। দীঘিটিতে একটি স্তম্ভ রয়েছে যা এটির সৌন্দর্যের নিদর্শন বহন করে।
তবে এই স্তম্ভ নির্মাণের ইতিহাস সঠিকভাবে জ্ঞাত নয়। অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ মনে করেন, মৌর্য বাংলার অঞ্চলে পতনের পর এটি নির্মাণ করা হয়নি। আরও কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, দীঘির স্তম্ভটি তৃতীয় শতকের মধ্যে নির্মিত হতে পারে। স্থানীয়দের কথার ভিত্তিতে প্রচলিত আছে, দিবর দীঘি এক রাতের মধ্যেই খনন করা হয়েছিল।
সংস্কৃত শব্দ 'কৈবর্ত' থেকে 'দিবর' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। এই 'দিবর' শব্দের উৎপত্তি নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার আলেকজান্ডার কানিংহামের মতে, 'দিবর' নামটি পাল রাজা দেবপালের অপভ্রংশ বলে তিনি মনে করেন।
দিব্যকের রাজত্বকালে, যুবরাজ রামপাল বরেন্দ্র অঞ্চল দিব্যকের থেকে জয় করার চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যর্থ হয়। এই সফলতার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য দিব্যক একটি স্তম্ভ নির্মাণ করেন। প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতামত অনুযায়ী, কৈবর্ত রাজা ভীমচাচা দিব্যকের স্মৃতিরক্ষা করতে এই স্তম্ভটি তৈরি করেছিলেন।
১৮৭৯ সালে আলেকজান্ডার কানিংহাম প্রাচীনকালে জনপ্রিয় এই স্তম্ভটি পরিদর্শনে যান । এই কাঠামোতে কোনও সোজা প্রান্ত নেই; এর মধ্যে ৯টি কোণ আছে এবং প্রত্যেকটি কোণ একে অপরের মধ্যে প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার দূরে। স্তম্ভের উপরে তিনটি গোলাকার সীসাকৃতি লাইনের সুশোভিত অলঙ্করণ আছে এবং সর্বোচ্চ অংশে আমলকের অলঙ্করণ তুলিত এবং মুকুটাকৃতি অলঙ্করণ উল্লেখ করা হয়।
দিবর দীঘির এই স্তম্ভকে “কৈবর্ত স্তম্ভ” নামেও অবহিত করা হয়ে থাকে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের দাবি, এটি যেভাবেই নির্মাণ করা হোক না কেন স্তম্ভটি এত বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়।
এই দীঘিটি বর্তমানে নওগাঁ জেলা প্রশাসন দেখভাল করছে এবং তাঁদের থেকে লিজ নিয়ে স্থানীয়রা এখানে মাছ চাষ করে থাকেন।
প্রতিবছর দূর দূরান্ত থেকে দেশি বিদেশি পর্যটক, স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীসহ পরিবার পরিজন নিয়ে বহু মানুষ এখানে ভ্রমণ করতে আসেন। নওগাঁ জেলায় বনভোজনের কথা মাথায় আসলেই দিবল দীঘির কথা আসে।
দেশের যে কোন অঞ্চল থেকে নওগাঁ জেলার সদরে যেতে চাইলে সাপাহারের বাসে চড়ে যেতে। সাপাহারের বাস টার্মিনাল থেকে উঠে দিবর দীঘির মোড়ে নেমে যেতে হবে। এই মাধ্যমে নওগাঁ থেকে দিবর দীঘি যেতে হতে বাসে প্রায় ৫৫ কিঃ মি পাড়ি দিতে হবে।
এই দূরত্ব অতিক্রম করতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। ঢাকা থেকে সরাসরি দিবর দীঘিতে পৌঁছতে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, আল নাফিসহ অন্যান্য বাস চলাচল করে। সাপাহারে আসার পর ভ্যান বা রিকশা ভাড়া করে দিবর দীঘিতে যেতে পারেন। রিকশার ভাড়া প্রতি ব্যক্তি ১০ টাকা।
আবাসিক হোটেলে থাকার সুবিধা সাপাহারে সীমিত রয়েছে। তবে যেকোন আবাসিক হোটেলে থাকতে পারবেন নিশ্চিন্তে কিন্তু এগুলো মানসম্পন্ন মনে না হলে নওগাঁ সদরে এলে ভালো আবাসিক হোটেল বুক করা যাবে।
সাপাহারে ৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা মধ্যের ভালমানের থাকার হোটেল বুক করতে পারবেন। তবে এসি রুম চাইলে বাজেট বাড়াতে হবে। লাঞ্চ কিংবা হাল্কা নাস্তা সাব্বির, সম্রাট, আরামবাগ রেস্তোরাঁগুলোতে সব সময় খাবার পেয়ে যাবেন। তবে যাই খান বুঝেশুনে নিজ দায়িত্বে খাবেন।
ভ্রমণ শেষ হলে ঠিক একইভাবে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে আসবেন। আরেকটু কথা বলে রাখি, একসময় এই সাপাহার অবহেলিত অঞ্চল ছিল; কোন পর্যটক আসত না। আর আজকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে এই অঞ্চলের তরুণেরা এসইও, ওয়েব ডিজাইন ও ডিজিটাল মার্কেটিং এর মত কাজ করে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারছে।
আশা করি আপনাদের ভ্রমণ সুস্থ ও নিরাপদ হবে। নওগাঁ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আপনাদেরকে সালাম ও শুভেচ্ছা।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস